ধারাবাহিক- অরণ্যের অন্ধকারে (পর্ব-২)

অরণ্যের অন্ধকারে (পর্ব-২)
-দ্যুতিপ্রিয়া ও অর্কপ্রভ

 

(৫)

ওরা এখন তিনজনে মিলে মন্দিরের পাশে জলাশয়ের বাঁধানো ঘাটে এসে বসেছে। ঠান্ডা হওয়া ওদের চুল এলোমেলো করে দিচ্ছে বারবার। মন্দিরের পিছনে জঙ্গলটাকে কেন্দ্র করে নিরীক্ষণে ব্যস্ত হ্যালির কৌতূহলী চোখগুলো হঠাৎ দূরের ঘাট’টায় একটা লোককে দেখে আটকে যায়। হ্যাঁচকা টান মেরে আহনকে ইশারা করলো হ্যালি। লোকটা তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। ঠিক লোক বলা যায় না অনেকটা সাধু গোছের।
সাদা চুল সাদা গোঁফ, পরনের লাল থান। হাতে কি যেন একটা রয়েছে ঠিক বোঝা গেল না। কিছুক্ষণ এভাবেই কেটে গেল। দুই দলের চোখ যেন একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বীকে ঝাঁঝরা করে দিয়ে সবটুকু নিরীক্ষণ করে নিচ্ছে। এর মধ্যেই বেশ কয়েকজন সাধারণ মানুষ বেশ ভক্তিভরে সাধুটিকে যে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে কিছু কথাবার্তা বলে গেলো সেটা আহান বা হ্যালি কারোরই চোখ এড়ালো না। ওদিকে দুপুরের সূর্যি মামা মাথার ওপর উঠে পড়েছে। আর বেশিক্ষণ বসে থাকা গেলো না। হিংলার ডাকে ওদের উঠে পড়তে হলো। দু’জোড়া পা গাড়ির দিকে অগ্রসর হলেও ওদের মন বা নজর পরে রইলো সাধুটির দিকে। কিছুক্ষন পর সাধুটিও ভায়ামাতাভির ঘন জঙ্গলে মিলিয়ে গেলো।

(৬)

“বাঁচা আমাকে হ্যালি!” কাতর কণ্ঠে আহান বলে ওঠে, কিন্তু কোথায় হ্যালি? এ যে হিংলা! ও এরকম অদ্ভুত ভাবে হাসতে হাসতে আহানের দিকে এগিয়ে আসছে কেন? ওর হাতেই বা ওটা কিসের মেশিন? একদম কাছে চলে এসেছে হিংলা.. আহান ছুটে পালানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পালাতে পারছে না.. পাগুলো পুরো অবশ.. কেউ যেন ওকে পুরো নিয়ন্ত্রণে করে ফেলেছে! না না.. আহান লাফিয়ে উঠে পড়ে সোফা থেকে। রীতিমতো হাঁপাচ্ছে, পুরো কপাল ঘামে চপ চপ করছে। “কি ভয়ানক স্বপ্ন! বাপরে বাপ..” নিজের মনেই বলে ওঠে আহান। সন্ধ্যা অনেক আগেই হয়ে গেছে। ওর মনে আছে, বিকালের দিকেই ওরা ফিরে এসেছিল। তারপর ও ফ্রেশ হয়ে ড্রইংরুমের সোফায় এসে বসে কিসব যেন ভাবছিল। কখন যে দু’চোখের পাতা এক হয়ে গেছে খেয়াল নেই। হুস ফিরলো, হ্যালির ডাকে। ততক্ষণে হ্যালি ফ্রেশ হয়ে দু’প্লেট লুচি তরকারি নিয়ে হাজির। “কি এত ভাবছিস বলতো? কাল থেকেই দেখছি..কাল বিকেলে কি যেন একটা বলতেও যাচ্ছিলিস। তারপর যা যা সব ঘটলো!” কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলতে বলতেই হ্যালি আহানের পাশে এসে বসলো। ততক্ষণে আহান ওর হাত থেকে এক প্লেট লুচি তরকারি ছোঁ মেরে নিয়ে নিয়েছে। দু’টি লুচি গলাধঃকরণ করে আহান একটু আরাম করে শুরু করলো সকালে বাইনোকুলারে দেখা সেই অদ্ভুত মানুষটার কথা, “তাও শুধু আজ নয় আগের দিন বিকেলেও আমি লক্ষ্য করেছি ওরকম একজন লোককে…” বলে বাঁ হাতে করে ক্যামেরাটা এগিয়ে দিল হ্যালির দিকে।
“কিন্তু আমি ভাবছি সাধুটাকে নিয়ে, কিভাবে দেখছিল আমাদের দেখিস নি? চাহনিটা আমার একদম ভালো লাগে নি” একদমে কথাগুলো বলে ফেললো হ্যালি। সাথে দুজনেরই মাথায় ঘুরছে নিখোঁজ মানুষগুলোর কথা‌।
কি হয় জঙ্গলের মধ্যে? কেন মানুষগুলো ফিরে আসেনা? কোনো জন্তু জানোয়ার নেই তো? না সত্যি কোনো অশরীরি কিছু আছে সেখানে? এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ লোডশেডিং হয়ে গেলো। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার‌। “এখানে তো generator বা inverter থাকার কথা” হ্যালির কথাটা শেষ হতে না হতেই আহান উঠে পড়লো। “দাঁড়া তো একবার ম্যানাজারের সাথে কথা বলে আসি। এখানে যে কারেন্ট নেই সেটা মনে হয় ওরা জানেই না।” এমনিতে হ্যালির কোনো ভয়ডর নেই। কিন্তু আজ আহান বেরিয়ে যেতে না যেতেই হ্যালির গা’টা কেমন ছমছম করে উঠলো। ঘরের জানলা দরজা সব বন্ধ, কিন্তু কোথা থেকে যেন একটা বরফের মতো ঠান্ডা হওয়া হ্যালিকে স্পর্শ করে যাচ্ছে বারবার, হ্যালি পুরো কেঁপে উঠলো যখন হঠাৎই ঘরের সমস্ত বন্ধ দরজা জানালাগুলো সজোরে খুলে গেল। মনের সমস্ত সাহসকে একজায়গায় করে হ্যালি উঠে বারান্দার দিকে যেতে গেল। কিন্তু এক পা এগিয়েই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো। দু’টো লাল চোখ যেন ওকে বশীভূত করে ফেলেছে। পাগুলো পুরো অসাড়, ওর শরীরের সমস্ত রক্ত যেন কেউ শুষে নিচ্ছে…
ওদিকে আহান তখনও বেশিদূর যায়নি, পাহাড়ি উঁচুনিচু রাস্তায় অন্ধকারে হাঁটার অসুবিধা হচ্ছে। হঠাৎ পিছনে হ্যালির রক্তজল করা চিৎকার যেন এক নিমেষে পাহাড়ের নিস্তব্ধতাকে খান খান করে দিলো। পড়ি কি মরি করে ছুটলো আহান রিসোর্টের দিকে। ঘরের দরজা খুলে যখন ড্রয়িং রুমে ঢুকলো তখন অন্ধকারে একটা ছায়ামূর্তিকে আহান স্পষ্ট বারান্দার পাশ দিয়ে যেতে দেখলো। চট করে মোবাইলের ফ্লাশ লাইটটা জ্বালিয়ে দৌড়ে গেল বারান্দার দিকে। কিন্তু তখন চারদিকে কেউ নেই। জলের পাইপ বেয়ে পাহাড়ের খাদ ধরে নিচে নামবে কিনা ভাবছে, হঠাৎ খেয়াল পড়লো হ্যালির কথা। ওর ওই রক্ত জলকরা চিৎকারটার কথা….
“হ্যালি.. হ্যালি” কোনো সাড়া শব্দ নেই। আহানের গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এলো। হাতের মোবাইলে চার্জ কম থাকায় ফ্লাশ লাইটটা অনেকক্ষণ আগেই নিভে গেছে। অন্ধকারে এলোপাতাড়ি ভাবে আহান খুঁজতে লাগলো হ্যালিকে। হঠাৎই বেখেয়ালে কিছুতে যেন ধাক্কা খেয়ে আহান পড়ে গেল মাটিতে। সাথে সাথে কারেন্টটাও চলে এলো।
“হ্যালি..” আহানের গলা দিয়ে তখন আর আওয়াজ বেরোচ্ছে না।
ড্রইং রুমের মেঝেতে হ্যালি পড়ে আছে। ঘাড়ের কাছে এক খাবলা রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। দু’ মিনিট সময় লাগলো আহানের নিজেকে শক্ত করতে। তারপর চটজলদি হিংলাকে ফোন করলো হ্যালির ফোন থেকে। নাহ্ এই সময় ভেঙে পড়লে চলবে না। পাঁজাকোলা করে হ্যালিকে তুলে নিয়ে গিয়ে ওর ঘরের বিছানায় শুয়ে দিলো আহান। হিংলাও পাশের সার্ভেন্ট কোয়াটার থেকে ততক্ষণে হাজির।

(৭)

“কোনো কিছু রক্ত খেকো প্রাণী বেশ খানিকক্ষণ ধরে রক্ত খেয়েছে। কিন্তু এখানে ওরকম কোনো প্রাণী নেই। এমন কি ভায়ামাতাভি জঙ্গলেও নেই, সুতরাং এ কোন অশরীরির কাজ। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখন থেকে নাকি ওদের ফিরে যাওয়াই ভালো।” কথাগুলো বলে ডাক্তার বাবু ফিরে গেছেন প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট হলো। হ্যালির তখনও জ্ঞান ফেরেনি। আহান ওর মাথার পাশে বসে। হিংলা গেছে ওষুধপত্রগুলো আনতে।

আর নিজেকে শক্ত রাখতে পারল না আহান, চোখের কোন থেকে দু’ ফোঁটা জল হ্যালির কপালের ওপর পড়লো- ছিঃ ছিঃ! দিনদিন ও যেন কেমন একটা হয়ে যাচ্ছে। তখন ওই সব না দেখে হ্যালিকে কোথায় দেখবে তা না! নিজের guilty feelটা যেন কিছুতেই কম হচ্ছে না আহানের।
“তুই আবার কাঁদিস ও নাকি!” হ্যালির ক্ষীণ শব্দ, আহান ততক্ষণে ওর ভেজা চোখগুলোকে মুছে নিয়েছে।
এতদিনের বন্ধুকে এভাবে কাঁদতে দেখে হ্যালি একটু হাসার চেষ্টা করলো। আহানের সাহায্যে ও এখন একটু উঠে বসতে পেরেছে। যদিও এখনো যে ভালোমতো দুর্বলতা আছে, সেটা ভালো ভেবেই বুঝতে পারছে।
আহান বারবার করে কথা বলতে বারণ করলেও সন্ধ্যেবেলার পুরো ঘটনাটা বললো। আহানও বললো কি কি হয়েছে ওর ঘরে আসার পর থেকে।

সব কিছু শুনে হ্যালির মনে জেদ চেপে গেল কালই নাকি ও ওই জঙ্গলে যাবে।
“না দিদিমণি ইয়ে নেহি হো সাক্তে..” হিংলার গলা। ওষুধ নিয়ে ফিরে এসেছে…
“ম্যায় সব কুছ শুনে নিয়েছি দরওয়াজেকে পিছেসে দাদাবাবু, দিদিমণি.. মুঝে মাফ করে দেবেন। কিন্তু কাল হি আপ লোগ নিজের গাঁওমে ওপাশ জাওগে, ব্যস।”

দূরের কোনো ঘড়িতে রাত দশটার ঘন্টা পড়লো।
ঘরের মধ্যে এক অদ্ভূত নিস্তব্ধতা। আহান ভালো করেই জানে হ্যালির জেদের কথা। একবার যখন কিছু ভেবেছে তখন সেটা করেই ছাড়বে। আহানও এর শেষ দেখতে চায় চিন্তা শুধু হ্যালিকে নিয়ে। ওদিকে হিংলাও আজ রাতে দাদাবাবু দিদিমনিকে একা ছাড়তে নারাজ।

(৮)

রিসর্টের সব জানালা দরজাই এখন বন্ধ। তিনজন এখন ঘরের মধ্যে গোল করে বসে। একটা গভীর নিস্তব্ধতা। দেওয়াল ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটাটা চলার শব্দ আর প্রত্যেকের স্বাসপ্রশ্বাস যেন প্রতিমুহূর্তে নিস্তব্ধতাটাকে বারবার ভেঙে চুরচুর করে দিচ্ছে।
রাতে ম্যানেজারের রুমে ফোনটা ঝনঝন করে উঠলো। “হ্যালো.. Mr. Ahan বলছি… বলছি, কাল ভোরেই আমরা রুম ছেড়ে দিচ্ছি… আমার বন্ধুর শরীরটা ঠিক নেই, তাই আমরা ফিরে যাচ্ছি… সকাল সাতটায় যদি একটা গাড়ির ব্যবস্থা করা যেত তাহলে খুব ভালো হতো.. আচ্ছা নমস্কার…” ঘড়িতে রাত দেড়টার ঘন্টাটা বাজার সাথে সাথে ফোনটাও কেটে গেল।
রাতে ঘরের মধ্যে যে কি হলো সেটা বাইরের কেউই জানতে পারলো না। হ্যালিকে নিজের ঘরে শান্তিতে ঘুমাতে দেখে আহানও নিজের ঘরে এলো ওদিকে হিংলা দিদিমনিকে পাহারা দেওয়ার জন্য ডাইনিং-এ থেকে গেলো সেই রাতের মতো। সকাল সাতটা, রিসর্ট থেকে দুইমূর্তি হিংলাকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। গাড়ি বলা ছিল। হোটেলের সব কাগজের কাজ শেষ করে ম্যানাজারের সাথে ছোট কুশলী বার্তা সেরে তিনজনেই গাড়িতে উঠে পড়লো। পথে সেরকম কেউই কথা বললো না। হ্যালির শরীর খুবই খারাপ। সে এখন আহানের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। আগের রাতের ঘটনা যে তিনজনের মনেই গভীর দাগ কেটেছে সেটা বাইরে থেকে বোঝা গেল না। এমন কি হিংলাও কেমন একটা গুম মেরে রয়েছে। গাড়িটা এসে যখন বিশাখাপত্তনম স্টেশনে থামলো তখন ঘড়িতে দশটা ছুঁইছুঁই। গাড়িটাকে ছেড়ে দিয়ে তিনজনে এখন স্টেশনের ওয়েটিং রুমে বসে। ট্রেন আসবে। সেই বারোটায়।
বারোটার ট্রেনটা যখন বিশাখাপত্তনম স্টেশন থেকে বেরিয়ে গেল তখন হিংলার পিছন পিছন যে আরো একজন ভায়ামাতাভি যাওয়ার উদ্দেশে স্টেশন থেকে বেরোলো সেটা কারোরই চোখে পড়লো না।

(৯)

ট্রেনটা যখন পালাসা স্টেশনে থামলো তখন ঘড়িতে বিকাল সাড়ে তিনটে বাজছে। স্টেশনের বাইরে একটা কালো রঙের গাড়ি অপেক্ষা করছে। ট্রেন থেকে নেমে আহান আর হ্যালি গাড়িটার দিকে এগিয়ে গেলো।
টানা পাঁচ ঘন্টা গাড়ি জার্নির পর যখন আহান আর হ্যালি ভায়ামাতাভির মাতাজির মন্দিরের সামনে এসে পৌঁছালো ততক্ষণে পথের ক্লান্তি ভ্যানিশ হয়ে গেছে। মন্দিরকে একবার প্রণাম করে দুজনে মিলে তালাবের ঘাটে উপস্থিত হলো। একটা নৌকো বাঁধা রয়েছে। নৌকার মালিক যখন আহান আর হ্যালির সামনে এসে দাঁড়ালো। তখন ওদের দুজনেরই চোখগুলো আনন্দে চিকচিক করে উঠলো,হিংলা! তালাবের জলটা এতটাই পরিস্কার যে ঘন অন্ধকারেও নিজেদের অবয়ব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। হ্যালি বার দুয়েক জলে হাত ডোবালো। জঙ্গলটা যতই কাছে এগিয়ে আসছে ততই কিরকম গা’টা ছমছম করতে লাগলো ওদের।
“কি অদ্ভুত রকমের শান্ত তাই না?” আহান ফিসফিস করে বললো।
“একটা ঝিঁঝি পোকাও অব্দি ডাকছে না দেখেছিস?” আহানের সুরে হ্যালিও সুর মেলালো।
“ইতনা বড় জঙ্গল মে কিসি চিজ কো
ঢুঁননে যায়ে তো বহুত দিন লাগ যায়গা” হিংলার গলা। ও যে বেশ উত্তেজিত সেটা বোঝাই গেলো ওর গলা শুনে। হ্যালি আহানকে বললো, “ঠিকই বলেছে হিংলা, এভাবে হবে না, আলাদা হতেই হবে” আহান সাথে সাথে বাধা দিয়ে বলে, “কখনোই না, তোকে আমি অন্ততঃ একা ছাড়ছি না।” হিংলা বলে, “আপ দিদিমনিকে সাথ যাও, ম্যায় একেলা হি সামহাল লুঙ্গা, মেরে চিন্তা করবেন না।” কোনো সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়লে আমরা অন্যজনকে জানিয়ে দেবো- কথাগুলো বলতে বলতেই আহানদের নৌকোটা একটা পরিষ্কার জায়গায় দাঁড় করালো হিংলা। ঝুপ ঝুপ করে সব নেমে পড়লো। তারপর তিনজনে মিলে নৌকোটাকে দুটো বড়ো গাছের আড়ালে লুকিয়ে ফেললো পাছে কেউ না দেখে ফেলে। আহান ওর ব্যাগ থেকে একটা ধারালো ছুরি করে আশপাশ থেকে কিছু ডালপালা কেটে সেগুলো দিয়ে নৌকোটাকে ভালো করে আড়াল করে দিলো। তিনজনে মিলে ঘাপটি মেরে বসে রইলো ভোর হওয়ার অপেক্ষায়। কতক্ষণ যে এভাবে বসে ছিল, মাঝখানে ওরা পালা বদল করে ঘুমিয়েও নিয়েছে একটু। পরের দিন যখন আহান আর হ্যালি ডান দিকে আর হিংলা বাঁ দিকের রাস্তাটা দিয়ে চলতে শুরু করলো তখন ভোরের আলো সবে ফুটছে।

(১০)

হিংলা পুরো ভাইজাকটা চোষে ফেললেও এই জঙ্গলে আগে কখনো আসে নি। সে সতর্ক দৃষ্টি রেখে ধীর পায়ে এগোতে লাগলো। সারি সারি গাছ শুধু কিন্তু কোনো জন্তু জানোয়ার নেই। ভারী অবাক হলো। দূর দূর পর্যন্ত নতুন কিছু চোখে পড়লো না। জঙ্গলটা এতটাই ঘন যে মানুষ রাস্তা গুলিয়ে ফেলতে বাধ্য। হয়তো সেই জন্যই মানুষ একবার ঢুকলে আর ফিরে আসে না। মনে মনে চিন্তা করে সে, হঠাৎ ভাইয়ের কথা মাথায় এলো। সে কি এখনো বেঁচে আছে? জঙ্গলের কত ভিতরে সে পৌঁছে গেছে, কি অবস্থা আছে, কিছুই জানে না। একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল, হঠাৎ একটা জিনিস দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে হিংলা।ঘন জঙ্গলে একই পথ যদি কেউ বারবার ব্যবহার করে তাহলে ঘাস পাতা একটু ফিকে হয়ে যায় হিংলা সেরকমই দু’টো পথ আবিষ্কার করে ফেলেছে, একটা ডান দিকে চলে গেছে অন্যটা বাঁ দিকে। এ জঙ্গলে কোনো জন্তু তার এখনো অব্দি চোখে পড়েনি। তাহলে কি কোনো মানুষ? তার ভাই? এই পথেই কি সে বারবার ঘুরছে? এসব চিন্তা তাকে মুহূর্তে উত্তেজিত করে তুললো। কিন্তু সে যাবে কোন দিকে রাস্তার ডান দিক দিয়ে নাকি বাম দিক দিয়ে? একটু ভেবে বাম দিকের পথই নিলো। মনে কোথাও যেন একটু একটু আশার আলো দেখা দিচ্ছে। অমনি একটা খসখস শব্দ তার সব ইন্দ্রিয়কে সতর্ক করে দেয়। হিংলা থেমে যায়। বোঝার চেষ্টা করে শব্দটা কথা থেকে আসছে।

(১১)

এদিকে আহান আর হ্যালি এই জঙ্গলে প্রথম এলেও তাদের জঙ্গলে আসার অভিজ্ঞতা আগেও আছে। দুজনেই সতর্ক দৃষ্টি নিয়ে এগোতে লাগলো। অল্প একটু এগিয়েই আহান থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো। গলায় একটা চাপা উত্তেজনা, “এটাই তো খুঁজছিলাম!”
প্রথমে হ্যালি বুঝে উঠতে পারে না। আহান তাকে পথের মতো একটা রাস্তা দেখিয়ে দেয়। “এ পথ দিয়ে নিশ্চয়ই কেউ যাতায়াত করে” হ্যালি বলে উঠে, একটু এদিক ওদিক দেখে নিয়ে ওরা ওই রাস্তাটাকে অনুসরণ করতে থাকে। এখন তারা জঙ্গলের একটু ঝোপের মধ্যে দিয়ে এগোচ্ছে। ওদের একটু পাশ দিয়েই রাস্তাটা গেছে। যাতে হুট করে ওই লোক চলাচলের রাস্তায় কেউ ওদের ধরে না ফেলে সেই জন্য।
অল্প কিছু দুর যেতেই একটা বড়ো গাছ দেখতে পায় ওরা দুজন, “সেই সাধুটা না!” হ্যালি উত্তেজিত হয়ে আহানের হাত খামচে ধরেছে. এদিকে সাধুটিও একটা বড়ো গাছের তলায় বসে একজনের সাথে কথা বলছিলেন, দেখে চাকর বলেই মনে হলো ওদের। জঙ্গলের ভিতরে একটা খসখস শব্দ শুনে সাধুটি লোকটাকে চলে যেতে বললেন। লোকটা চলে যেতেই একটা গম্ভীর গলার আওয়াজ আহান আর হ্যালির হৃদপিন্ডকে মনে হলো যেন ওদের কলজে থেকে বার করে নিয়ে আসছে…”কোন হ্যায় উধার?”
আর উপায় নেই, আহান বেরিয়ে এলো গাছের ফাঁক থেকে, “ও ভাই যারা এধার শুননা” আহান চিৎকার করে লোকটাকে ডাকলো। কিন্তু সে যেন কিছু শুনতেই পেলো না। কেমন যান্ত্রিক ভাবে চলতে চলতে জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলো। সাধুর কাছে আসতেই তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, “ইহা পার ক্যা কার রাহে হয় তুম? ইয়ে জায়গাকে বারে ম্যায় কুচ নাহি শুনা ক্যা? টুরিস্ট লোগো কাভি ইহা মানা হ্যয়।” আহান একটু ভয়ের সাথেই বললো, “ও আদমি কোন থা? আপ ইধার রেহেতে হো ক্যা?” এবার গর্জে বলে উঠলেন তিনি, “হাঁ, ম্যায় ইহা পার আপনা ধ্যান করতা হ্যায়। আগার ভালা চাহতে হোয় তো জলদি নিকাল যাও..” আহান আরো কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলো কিন্তু তিনি পাত্তাই দিলেন না। চোখ বড়ো বড়ো করে এক দৃষ্টে আহানের দিকে চেয়ে আছেন আর সাথে বিড়বিড় করতে লাগলেন, যেন মন্ত্র পড়ছেন। গাছের পিছন থেকে হ্যালি খেয়াল করলো আহান যেন কেমন যন্ত্রের মতো অন্য দিকে হেঁটে চলে যাচ্ছে। “এইরে লোকটা আহনকে হিপনোটাইজ করে ফেলেছে!” হ্যালি জঙ্গলের ভিতর দিয়েই যতটা সম্ভব নিজেকে লুকিয়ে আহানের পিছন নিলো। সাধুর নজর থেকে বেশ কিছুটা দূরে যেতেই হ্যালি পিছন থেকে আহানকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো যাতে ওর ঘোরটা কেটে যায় আর হলোও তাই, “কিরে এভাবে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলি কেন?” আহানের গলায় একটু রাগের আভাস। হ্যালি গাছের পিছন থেকে যা যা দেখেছে পুরোটা বললো।
সবটা শুনে আহানের গলায় তখন উৎকন্ঠার রেখা, “শোন আমার মনে হয় এখানে কিছু একটা আছে, নাহলে সাধুটিই বা আমাকে ওরকম হিপনোটাইজ করে এখান থেকে পাঠাতে কেন চাইছে! আর কে ওই চাকরটা? এতবার করে ডাকলাম একবারও ঘুরেও তাকালো না! শোন ওই চাকরটাকে খুঁজে বার করতে হবে..” হ্যালিও সায় দিলো।

 

চলবে…………..

Loading

Leave A Comment